ঢাকা , বুধবার, ০১ জানুয়ারী ২০২৫ , ১৮ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গ্যাস-সংকট বাড়ার শঙ্কা

ডেস্ক রিপোর্ট
আপলোড সময় : ২৯-১২-২০২৪ ০১:২৫:২০ অপরাহ্ন
আপডেট সময় : ২৯-১২-২০২৪ ০১:২৫:২০ অপরাহ্ন
গ্যাস-সংকট বাড়ার শঙ্কা সংবাদচিত্র: সংগৃহীত
দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জ্বালানির সংকট। বিশেষ করে গ্যাসের জোগান নিশ্চিত করা বাংলাদেশ তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলার) জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। একদিকে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান দিন দিন কমছে। অন্যদিকে শিল্প কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও আবাসিক গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। উচ্চমূল্যে লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করে এ সংকটের আপাতত সমাধান করা গেলেও রয়েছে প্রচণ্ড আর্থিক সংকট। এ ছাড়া চাইলেও বেশি পরিমাণে এলএনজি আমদানি করা যাবে না অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে। ফলে আগামী বছরের শুরুতেই গ্যাস সরবরাহে বড় হোঁচট খাওয়ার শঙ্কায় আছে পেট্রোবাংলা।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, আটটি গ্রাহক শ্রেণিতে প্রতিদিন গ্যাসের অনুমোদিত লোড প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। অথচ এলএনজিসহ সরবরাহ করা হচ্ছে গড়ে ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশ। দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকটে এরই মধ্যে প্রায় ৩০০ শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। সামনে আরও অনেক শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এর মধ্যেই আগামী বছরের শুরুতেই গ্যাস সংকট আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তার সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যমতে, এখন শীত মৌসুম চলায় গ্যাসের সংকট থাকলেও সেটা তেমন একটা টের পাওয়া যাচ্ছে না। তবে আসন্ন গ্রীষ্মে বিশেষ করে আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের চাহিদা অনুযায়ী জোগান নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তারা বলছেন, অন্য বছরগুলোয় গ্রীষ্মকালীন চাহিদাকে বিবেচনা করে আগাম প্রস্তুতি নেওয়া গেলেও এ বছর কিছুটা ব্যতিক্রম। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, গ্যাস সরবরাহে পেট্রোবাংলার চ্যালেঞ্জগুলোর বিস্তারিত তুলে ধরে জ্বালানি বিভাগে চিঠি পাঠানো হয়েছে। এখন জ্বালানি বিভাগের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে সংকট মোকাবিলায় পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা। এ কর্মকর্তা বলেন, ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহ সংক্রান্ত বিষয়ে জ্বালানি বিভাগে চিঠি দেওয়া হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় সেটা বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তিনি বলেন, আগের রাজনৈতিক সরকারের সময়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা গেলেও বিদ্যমান বাস্তবতায় সিদ্ধান্ত পেতেও সময় লাগছে। সবাই এখন খুবই ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। বিশেষ করে কর্মকর্তাদের বার বার বিবেচনা করতে হচ্ছে, কোনো সিদ্ধান্তের কারণে পাছে বিপদে না পড়েন।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, নানামুখী সংকটে দেশের জ্বালানি খাত। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে প্রতিনিয়ত গ্যাসের জোগান কমছে। জ্বালানি পণ্যের (তেল, গ্যাস, কয়লা ইত্যাদি) পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য জোগান না থাকায় ক্রমান্বয়ে এ খাত হয়ে পড়ছে আমদানিনির্ভর। যদি অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে শিগগির গ্যাসের সন্ধান না মেলে, তবে আরও বেশি পরিমাণ জ্বালানি পণ্য আমদানি করতে হবে। কিন্তু আমদানির ক্ষেত্রেও সরকার নানামুখী সংকটে পড়ছে। ডলারের দাম তরতর করে বেড়ে যাওয়ার কারণে অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। এ ছাড়া দেশের জ্বালানি খাতে আমদানিনির্ভরতা ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে আর্থিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে দেশ। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারের কাছে বর্তমানে বিভিন্ন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের বিশাল পরিমাণ অর্থ পাওনা রয়েছে। একই সঙ্গে সংস্থা ও কোম্পানিগুলোর ওপর প্রয়োজনীয় জ্বালানি আমদানি ও সরবরাহের চাপ রয়েছে। তবে এলএনজি আমদানি করতে বা পাওনাদারদের টাকা পরিশোধ করতে প্রয়োজনীয় অর্থের ছাড় মিলছে না। ব্যাংকগুলো চাহিদা অনুযায়ী এলসি খুলছে না।

পেট্রোবাংলার জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এখন ডলারের দাম প্রায় ১৩০ টাকায় ওঠে গেছে। ১০৮ টাকা প্রতি ডলার হিসাব করে যদি এলএনজি আমদানির কথা ভাবা হয়ে থাকে, তাহলে ডলারের দাম বৃদ্ধির কারণে এক ডলারে সরকারের প্রায় ২২ টাকা বেশি পড়ছে। আগামী বছরের জন্য ১১৫টি এলএনজি কার্গো আমদানির হিসাব ধরা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি কার্গো আমদানি করতে গড়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা লাগে। এ বিশাল পরিমাণ এলএনজি আমদানি সত্যিই বড় চ্যালেঞ্জের। এ ছাড়া দেশীয় উৎস থেকে ক্রমাগত গ্যাসের চাহিদা কমে যাওয়ার বিষয়টিও ভাবিয়ে তুলছে পেট্রোবাংলাকে।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) থেকে আগে প্রতিদিন গ্যাস উত্তোলন হতো ৬১১ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু বর্তমানে তা হ্রাস পেয়ে ৫৩০ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে। একই সঙ্গে সবচেয়ে বড় গ্যাস সরবরাহকারী বিদেশি কোম্পানি শেভরন মৌলভীবাজার-সিলেট অঞ্চলের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে আগে যেখানে প্রতিদিন সরবরাহ করত ১ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট, সেখানে এখন সরবরাহ হচ্ছে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এটি আরও কমে যাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তাল্লো পরিচালিত গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকেও প্রতিনিয়ত সরবরাহ কমছে। দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের উত্তোলন কমে যাওয়ায় পেট্রোবাংলা বেশি উদ্বিগ্ন। এ ছাড়া পেট্রোবাংলার প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পাওনা পড়ে আছে বিভিন্ন সংস্থা ও কোম্পানির কাছে। এর মধ্যে শুধু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডেরই (পিডিবি) বকেয়া প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা।

পেট্রোবাংলার কর্মকর্তারা সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ নিয়ে। কারণ পিডিবি প্রতিবছর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা দিয়ে থাকে। যদিও সেখানে গড়ে এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করাই কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গরমে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে সর্বোচ্চ। ফলে গ্যাস সরবরাহ করতে না পারলে লোডশেডিং বেড়ে জনমনে অসন্তোষ জন্মায়। একই সঙ্গে সেচ মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে না পারলে কৃষিকাজেও সংকট তৈরি হয়। বিশেষ করে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত কৃষিতে বিদ্যুতের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে।চলতি বছরের শুরু থেকেই গ্যাসের সংকট দেখা যাচ্ছে। শিল্প কারখানার উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাসাবাড়িতেও গ্যাস থাকছে না। এদিকে পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, শীতকালে গ্যাসের উৎপাদন কিছুটা কমেছে। এ ছাড়া বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানিও কমেছে। উল্টো প্রতিনিয়ত গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ফলে বাড়ছে গ্যাসের সংকটও। পেট্রোবাংলা বলছে, এলএনজি আমদানি কমার পাশাপাশি অন্যান্য উৎস থেকেও গ্যাস সরবরাহ কমেছে। এতে করে শিল্প ও আবাসিক গ্রাহকরা সংকটে ভুগছেন। চড়া দামে বিকল্প জ্বালানি কিনে উৎপাদন ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন রপ্তানিমুখী শিল্পের মালিকরা। বিশেষ করে নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ভালুকা, শ্রীপুর, মুন্সীগঞ্জের দিকে গড়ে উঠা শিল্প কারখানাগুলো চরম গ্যাস সংকটের মধ্যে আছে।

সম্প্রতি জ্বালানি উপদেষ্টার উপস্থিতিতে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শীর্ষপর্যায়ের এক ব্যবসায়ী জানান, এরই মধ্যে প্রায় ৩০০ শিল্প কারখানা গ্যাস সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আরও অনেক শিল্প কারখানাও একই কারণে ধুঁকছে। পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন গ্যাসের চাহিদা প্রায় ৫ হাজার ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট। তবে সর্বোচ্চ সরবরাহ কর হয় ২ হাজার ৭০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে উচ্চমূল্যে আমদানিকৃত এলএনজিও রয়েছে। গত একদশক ধরেই দেশে গ্যাসের সংকট বিরাজমান। বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহক চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছেন না।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন) কামরুজ্জামান বলেন, অনেক দিন ধরেই দেশ গ্যাসের সংকটের মধ্যে আছে। আমাদের চাহিদা বাড়ছে। অন্যদিকে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান কমছে। ফলে আমদানি করতে হচ্ছে। এ কর্মকর্তা এও জানান, নতুন কিছু গ্যাসক্ষেত্রের পাশাপাশি পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উত্তোলন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এদিকে গ্যাসের ঘাটতি নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেছেন, দিন দিন দেশে গ্যাসের উৎপাদন কমে আসছে। সামগ্রিক ভুল পরিকল্পনার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশকে। তিনি বলেন, দেশীয় গ্যাসের উৎস থেকে গ্যাসের জোগান বাড়ানোর তেমন চেষ্টা করা হয়নি। ফলে এলএনজি আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে গ্যাস সরবরাহ। এ অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষতে সংকট আরও বাড়বে।

সূত্র: আমাদের সময়

বাংলাস্কুপ/ডেস্ক/এনআইএন


প্রিন্ট করুন
কমেন্ট বক্স

এ জাতীয় আরো খবর

সর্বশেষ সংবাদ